বরগুনা প্রতিনিধি ॥ বরগুনায় মহামারির আকার ধারণ করেছে ডায়রিয়া। এক যুগের রেকর্ড ছাড়িয়ে জেলার পাচঁ হাজারেরও অধিক মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে আটজন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রতিদিন নতুন করে সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসছে আক্রান্ত রোগীরা। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা। দেখা দিয়েছে স্যালাইন সংকট। উপকূলের নদ-নদীতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি ও জীবানুযুক্ত পানি ব্যবহারে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। প্রতিদিন নতুন করে সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসছে আক্রান্ত রোগীরা। গত এক যুগ বা তারও বেশি সময়ের মধ্যে এ বছর বরগুনায় ডায়রিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ। বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৭০ জন। গত ২৪ ঘন্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯০ জন। সরকারি হিসেবে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত জেলায় মারা গেছেন ৪ জন। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ৮। এদের মধ্যে বরগুনার বেতাগী উপজেলার দুই জন, বরগুনা সদর ও আমতলী উপজেলার দুজন মারা গেছেন। এ ছাড়াও ৮ থেকে ২০ এপ্রিলের বরগুনার বেতাগীতে আরও ৪ জন বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ডায়রিয়া পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সরকারের রোগততত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল বরগুনায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। মার্চ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় মাসব্যপি আইইডিসিআরের ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করেন। দলটি জেলার সবেচেয় বেশি ডায়রিয়া আক্রান্ত এলাকা ঘুরে রোগীদের মল, বিভিন্ন উৎসের পানির নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে। আইইডিসিআরের তিনজন রোগতত্ত্ববিদ (চিকিৎসক) ও তিনজন কারিগরি সহায়ক এই দলে আছেন। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রোগতত্ত্ববিদ জাহিদুর রহমান। তিনি জানান, প্রতিবছরই এই মৌসুমে বিভাগে কমবেশি ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। কিন্তু এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। মূলত এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য তারা বরগুনায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ, আক্রান্ত ব্যক্তি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। একই সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের নানা বিষয় সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে যা বোঝা যায়, তাতে এ অঞ্চলের মানুষের একটি নেতিবাচক প্রবণতা হলো দৈনন্দিন কাজে খালের পানি ব্যবহার করা। বিশেষ করে সকালে ভাতের সঙ্গে খালের পানি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে। এই অভ্যাস বদলাতে হবে। গৃহস্থালিসহ সব কাজে নলকূপের পানি ব্যবহার করতে হবে। বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, আইইডিসিআরের অপর একটি প্রতিনিধিদল ১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তালিকা ধরে সমীক্ষা চালায়। এতে ৯৪ শতাংশ লোক গভীর নলকূপের পানি পান করলেও ৭১ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে খালের পানি ব্যবহার করে। সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে। প্রতিষ্ঠানটি বরগুনার খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে খালের পানিতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ২০ জন রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আইইডিসিআর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এর মধ্যে খাওয়ার ও গৃহস্থালিকাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো, খাল–নদীর পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া। আইইডিসিআরের প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে সিভিল সার্জন মারিয়া হাসান বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি চিঠি দিয়েছি।’ জেলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসপাতালগুলোর আনাচেকানাচে ভরে গেছে ডায়রিয়া রোগীতে। তিল পরিমাণ ফাঁকা নেই এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে। বিপুল পরিমান রোগীর কারণে দেখা দিয়েছে ঔষধ সংকট। বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ভান্ডাররক্ষক (স্টোর কিপার) মো. আমিনুর রহমান বলেন, বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ করোনার থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই হাসপাতালসহ কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য মজুদ ঔষধ ফুরিয়ে গেছে। তাই সেসব স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র এক প্রকার ভিক্ষা করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানের কর্মীরা। তিনি আরও বলেন, গতকাল বরগুনায় এক হাজার মিলি লিটারেরর তিন হাজার ও পাঁচশ’ মিলি লিটারের চার হাজার ব্যাগ স্যালাইন বরাদ্দ এসেছে। বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজে যোগাযোগ করে এই স্যালইনের বরাদ্দ এনেছেন। তাই সেই স্যালাইন তার সংসদীয় আসনের বামনা, বেতাগী ও পাথরঘাটা উপজেলা হাসপাতালে বরাদ্দা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে বরগুনা জেলার জন্য পাঁচ হাজার মিলি লিটার স্যালাইন বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে শুনেছি। তা এখন পর্যন্ত নিশ্চত হতে পারিনি। এ বিষয়ে বরগুনা বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর কারণে জেলার হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে তিল ধরার ঠাঁই নেই। বিপুলসংখক ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমসিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের স্যালাইন সংকট থাকলেও এই মুহূর্তে তা কিছুটা সমাধান হয়েছে। গ্রাম-গঞ্জসহ সর্বত্র মানুষকে ডায়রিয়ার বিষয়ে সচেতন করতে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
Leave a Reply